সম্পাদকীয়, শিলিগুড়ি, ভারতঃ যখনই আমরা ইউটিউব এবং ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখি। তখন প্রায়শই আমাদের চোখে চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাগুলো চোখে পড়ে। বিশেষ করে আপনি যদি কোনো আইটি সেক্টরে চাকরিরত থাকেন তাহলে প্রতিদিন অন্তত একবার লে অফ সংক্রান্ত ভিডিও বা পোস্ট আপনার চোখে পড়বে। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সরকারী এবং বেসরকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া হচ্ছে না। আগে সরকারি চাকরিতেই নিয়োগের প্রতিযোগিতায় বিশাল লম্বা লাইন দেখা যেত। কিন্তু এখন বেসরকারি ক্ষেত্রেও চাকরি পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে।
নব্বই দশকে আমারা বড়দের মুখে শুনতাম যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একবার ঢুকতে পারলেই উজ্জ্বল কেরিয়ার তৈরী হয়ে যেত। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে থেকে পাশ করে বেরোনোর পরেও ছাত্রছাত্রীরা উপযুক্ত প্যাকেজ পাচ্ছে না। আর প্যাকেজ পেয়েই বা কি করবে? যোগদান করার ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যেই জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে।
কেন গত দুই বছর ধরে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কর্মীদের লে অফের মুখে পড়তে হচ্ছে। এর সহজ উত্তর কোম্পানিতে অভাব। চাহিদার অভাব, কাজের অভাব, অর্থের অভাব, কর্মীদের দক্ষতার অভাব। সাধারণত এই চার প্রকার অভাবের মধ্যে যেকোনো একটি অভাব দেখিয়ে কর্মীদের লে অফ করানো হয়। কর্মী ছাঁটাই করে সংস্থার আর্থিক চাপ সাময়িক ভাবে সমাধান করা যায় ঠিকই কিন্তু চাহিদার অভাব (সংস্থার উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি কমে গেলে) এবং কাজের অভাব (পরিষেবামূলক কাজের প্রজেক্ট না থাকলে) এই সমস্যাগুলো সমাধান না করলে অবধারিতভাবে সংস্থাকে পুনরায় কর্মীদের লে অফ করতে হয়। তবে সবক্ষেত্রেই যে অর্থের অভাব, কাজের সমস্যা লে অফের কারণ হয় তা নয়। অনেকসময় দেখা যে দক্ষ কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপার হওয়ার আগেই যেকোনো কারণ দেখিয়ে সেই কর্মীদের ছাঁটাই করে দেওয়া হয়।
তবে দক্ষ কর্মীদের ক্ষেত্রে চাকরিতে অভাবের সমস্যার মুখে পড়তে হয়। অনেক সংস্থায় উপযুক্ত পরিশ্রম করা সত্ত্বেও দক্ষ কর্মীদের অনেক সময় কাজের স্বীকৃতির অভাব, প্রোমোশনের অভাব, সুস্থ কাজের পরিবেশের অভাব দেখা যায়। কিন্তু সংস্থাগুলি দক্ষ কর্মীদের সুবিধার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয় না। ফলে সেই দক্ষ কর্মীরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য সংস্থায় জয়েন করে অথবা স্টার্ট আপ অথবা ব্যাবসা শুরু করছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে কর্মীরা তাদের কর্মস্থলে সুস্থ কাজের পরিবেশের দিকে বেশী জোর দিচ্ছে।
বাজারের চাহিদার সঙ্গে নতুন দক্ষতা শিখতে না পারলে আগামী দিনে চাকরির অভাব আরো বাড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে এখনই বিভিন্ন সেক্টরে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে এবং কর্মী নিয়োগ আগের তুলনায় কমে গেছে। আগামী দিনে হিউম্যানয়েড রোবট পরিশ্রমশীল কর্মীদের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। এখন প্রযুক্তির এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে একটি প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ শিখতে না শিখতেই নতুন প্রযুক্তি চলে আসছে। তাই আগামী দিনে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা আরো তীব্রতর হবে।
এখন চাকরির অভাব এবং চাকরিতে অভাব দুটোই অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দুই অভাবের কারণে বাজারে পণ্য এবং পরিষেবা বিক্রি কমে যায়। ফলে পণ্য উৎপাদনকারী এবং পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির মুনফায় ঘাটতি দেখা যায়। ফলে সংস্থাগুলি নতুন কর্মী নিয়োগ করতে চায় না এবং কর্মী সংকোচনের দিকে ঝোঁকে। এই অভাবী চক্র ক্রমাগত চলতে থাকলে দেশে আর্থিক সংকট দেখা যায়।
আবার পণ্য এবং পরিষেবা বিক্রি কমে গেলে ব্যাবসা ক্ষেত্র থেকে দেশের সরকার কম পরিমাণে ট্যাক্স আদায় করতে করতে পারে। তখন দেশের সরকার ইনকাম ট্যাক্সের উপর জোর দেয়। ইনকাম ট্যাক্সের পরিমান বাড়লে চাকরিজীবিদের খরচের ওপরে টান পড়ে ফলে চাকরিতে অভাবের হার বৃদ্ধি হয়।
অন্যদিকে বেসরকারী সংস্থার মুনাফা ক্রমাগত ঘাটতি হলে শেয়ারবাজারে সংকটের সৃষ্টি হয়। বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে লগ্নি করা টাকা তুলে নিতে শুরু করে। দেশি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলে নিলে সাময়িক সংকটের সৃষ্টি হয়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা তুলে নিয়ে দেশি বিনিয়োগকারীরা অন্যত্র বিনিয়োগ করেন অথবা ব্যাঙ্কে জমা রাখেন। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের লগ্নি করা টাকা তুলে নিয়ে যদি অন্য কোনো দেশের বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে তখনই দেশে আর্থিক সংকট শুরু হয়। দেশের শেয়ারবাজারে আরো অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। দেশি বিনিয়োগকারীদের লগ্নি নষ্ট হতে থাকে। দেশের মুদ্রার মুল্য কমতে থাকে।
এই আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করার জন্য দেশের সরকার কতগুলি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যেমন দেশের রিজার্ভে থাকা ডলার, সোনা বাজারে যোগান দিয়ে আর্থিক সংকটের সাময়িক মোকাবিলা করতে পারে। এরপরেই দেশের সরকার খরচের ওপরে লাগাম টানতে শুরু করে। ফলে সরকারী চাকরিতে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হয়, শূন্যপদ সংখ্যার সংকোচন করা হয়, স্থায়ী কর্মী নিয়োগের পরিবর্তে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতে অনেক দেশে সরকারী কর্মীদের সরাসরি ছাঁটাই করা অথবা বাধ্যতামূলক অবসর নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সরকারী চাকরিতে চাকরির অভাব শুরু হলে বেসরকারি পণ্য এবং পরিষেবায় সংকট হতে পারে। বিগত কয়েক বছরের ডেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমেছে।
চাকরির অভাব এবং চাকরিতে অভাব থেকে চক্রকারে যে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়, এর মোকাবিলা সময়মত না করলে পরবর্তীকালে দেশে আর্থিক সংকটের সঙ্গে অনান্য সংকটের সৃষ্টি হয়। তখন সংকট মোকাবিলার জন্য দেশের সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং গবেষণা ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ কমাতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক সংকটের মোকাবিলার জন্য দেশের সরকার জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয়।
কোনো একটি দেশে এই সংকট হলে সেই দেশ অন্য দেশ থেকে লোন এবং আর্থিক সহায়তা নিয়ে হয়ত অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই সংকট যদি পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশেই হয়ে থাকে তখন পরিস্থিতি এমন জটিল হয় তখন প্রশ্ন ওঠে যে কোন দেশ কোন দেশকে সাহায্য করবে? এইভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দার সৃষ্টি হয়। সারা পৃথিবী জুড়ে চাকরির অভাব এবং চাকরিতে অভাব দুটোই দেখা যায়।
এখন ২০২৫ সাল।প্রায় পৃথিবী জুড়ে আর্থিক মন্দা এবং জীবিকা সংকট এবং অনিশ্চিয়তা। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি একত্রিত হয়ে আর্থিক এবং জীবিকা সংকট মোকাবিলার জন্য কিছু গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা তৈরী এবং সেগুলি বাস্তবায়ন করতে পারলে আশার আলো দেখা যেতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন