সোশ্যাল মিডিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে কিভাবে ওয়েব ব্লগিংকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে টিকিয়ে রাখা সম্ভব
ডিজিটাল ডেস্কঃ টেকনোলোজি, শিলিগুড়ি, নভেম্বর 13, 2024
![]() |
Image source: Freepik.com |
2024 সালের মার্চ মাসে গুগোল কোর আপডেট হওয়ার পরে সাধারণ ওয়েব ব্লগারদের অবস্থা হয়েছিল অনেকটা ওই রকম যে তারা শুকনো নদীতে মাছ ধরার জন্যে জাল, ছিপ ফেলে বসে আছে। অন্যদিকে নদীতে বাঁধ দিয়ে কেউ জল এবং মাছ দুটোই সহজে পেয়ে যাচ্ছে। ব্লগিংকে পেশা করতে গিয়ে কন্টেট লিখে অর্গানিক ট্রাফিক বা সার্চ ইঞ্জিনের রেজাল্টে আসার অপেক্ষায় বসে থাকা।
এখন ফেলো কড়ি মাখো তেলের যুগ। অ্যাড নেটওয়ার্কে টাকা না ঢাললে কোনোদিন ওয়েবসাইটের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না। সুতরাং ওয়েব ট্রাফিক হলো একটি ওয়েবসাইটের খাবার। যত খাবার খাবে ততই তার বৃদ্ধি হবে। দুই হাজার তিন হাজার টাকা দিয়ে কেনা .io ডোমেইন কিন্তু .com এর চেয়ে বেশী র্যাঙ্ক করে। তারপরে তো ওয়েব হোস্টিং-এর ব্যাপার আছে।
অনেকে বলছে AI তো সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে তাহলে আমার ওয়েবসাইটে লোকে ভিজিট করবে কেন? সেক্ষেত্রে আমি পাল্টা প্রশ্ন করি এরকম - যদি ক্রিকেট, ফুটবল খেলা মোবাইলে, টিভিতে দেখা যায় তাহলে হাজার হাজার মানুষ কেন মানুষ স্টেডিয়ামে ভিড় করে, কেন টিকিটের কালোবাজারি হয়? মোবাইলে, টিভিতে সিনেমা দেখা যায় তাহলে মানুষ কেন সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলে যায়?
নিশ্চয় ওই স্টেডিয়াম বা সিনেমা হল দর্শকদের এমন কিছু অনুভূতি দেয় যা মোবাইল বা টিভি থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। একই বিষয় কিন্তু AI এবং Search ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। কথায় বলে মানুষ অভ্যাসের দাস অধিকাংশ মানুষ একটা বিষয়ে অভ্যস্থ হয়ে গেলে তারা সহজে অন্যত্র যেতে চায় না। কিন্তু মানুষের নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বেশী তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অভ্যাস বদলাতে থাকে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে মানুষের অভ্যাস বদলানো যেতে পারে। সবটাই সাইকোলোজির খেলা।
সবচেয়ে বড় ভুল যেটা হয়েছে যে অধিকাংশ ওয়েব ব্লগাররা নিজের ব্লগের ব্যান্ড ভ্যালু তৈরী করতে পারেননি। তারা গুগোলকে White Label কন্টেট দিয়ে গেছে। ফলে ওয়েবসাইট ভিজিটররা কন্টেট পড়ে চলে গেছে। কোন ওয়েবসাইট থেকে পড়লো, কার লেখা পড়লো সেটা তাদের মনে নেই। ওয়েবসাইটের নাম মানুষের মেমরিতে নেই শুধু সার্চ ইঞ্জিনদের মেমোরিতে আছে। ওদিকে ব্লগারা এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে যে কিভাবে গুগোলে র্যাঙ্ক করা যায়, প্রথম পেজের রেজাল্টে থাকা যায়। সে এক বিশাল ইঁদুর দৌড়। আর এই ইঁদুর দৌড়ের ফল যে কি মারাত্বক সেটা AI আসার পরেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ওয়েব ব্লগাররা।
আমি কতগুলি কিওয়ার্ড লিখছি মনে মনে পড়ুন " পিজা, কোল্ড ড্রিঙ্কস, চিপস, টম্যাটো সস, স্মাটফোন, টিভি" কয়েক বার পড়ার পরে একটি কাগজে লিখুন যে আপনার এই কিওয়ার্ডগুলি পড়ার সময় কোন কোন পছন্দের ব্রান্ডের কথা মনে পড়ছে অর্থাৎ যেন আপনার চোখে ভেসে উঠেছে। এবার যদি আপনাকে বলা হয় যে আপনি একটি পিজার অর্ডার দিন তাহলে আপনি নিশ্চয়ই গুগোলে সার্চ করে অথবা যেকোনো ফুড ডেলিভারি অ্যাপ-এর গিয়ে আপনার পছন্দের ব্রান্ডের পিজা অর্ডার করবেন এবং এটার সম্ভাবনা প্রায় 90%
এই কারণে আমি ওয়েবব্লগারদের নিজেদের ব্রান্ড ভ্যালু বাড়ানোর কথা বলছি। ওয়েবসাইটকে কপিরাইটের আওতায় আনুন। না হলে আপনার পরিশ্রম করে লেখা কন্টেট অন্যেরা এসে কপি করে নিয়ে চলে যাবে। কপিরাইট থাকলে যারা নিজেরা পরিশ্রম করে কন্টেট তৈরী করেন তারা সঠিক গুরুত্ব পাবেন। ব্লগে কন্টেট রাইটারের নাম এবং পরিচয় অবশ্যই উল্লেখ করুন। এটা ব্রান্ড ভ্যালু তৈরী করার জন্য জরুরী। ব্লগে পপ আপ সাবক্রিপশন বোতাম রাখুন। ইউটিউব চ্যানেলের মত ওয়েব ব্লগ সাবস্ক্রাইবার যাতে বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিন।
লং টেইল কিওয়ার্ডের সঙ্গে ব্যান্ড ভ্যালুর একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ইউটিউবে দেখা যায় অধিকাংশ ব্যাবহারকারী সার্চের সময় কিওয়ার্ডের সঙ্গে চ্যানেলের নাম জুড়ে দেয়। যেমন আমি বাড়িতে কখনো কখনো নিজের পছন্দের রেসিপি রান্না করার আগে অনেক সময় ইউটিউবে রেসিপির সঙ্গে চ্যানেলের নাম লিখে সার্চ করে নিই। কিন্তু এরকম লং টেইল কিওয়ার্ড গুগোল সার্চে খুব কম ব্যাবহার হয়। তবে 2024 সালের মার্চ মাসের কোর আপডেটের পরে দেখেছিলাম গুগোল ব্রন্ডেড ওয়েবসাইটগুলিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া শুরু করছে। ফলে যেসব ওয়েবসাইটের ব্রান্ড ভ্যালু বেশী তাদের কন্টেন্ট সার্চ রেজাল্টে বেশী আসছে। এর ফলে হয়ত ভবিষ্যতে গুগোল সার্চে লং টেইল কিওয়ার্ড ব্যাবহারের গুরুত্ব বাড়বে।
আগেই আমি ব্লগ সাবস্ক্রিপশনের কথা লিখেছিলাম। যেসব ব্লগ ওয়বসাইটে প্রতিদিন গড়ে দশ হাজারের বেশী ট্রাফিক আসে সেই ব্লগগুলিতে পেইড সাবস্ক্রিপশন চালু করা উচিত। অর্থাৎ আপনার লেখা কন্টেটের কিছুটা অংশ ফ্রীতে পড়তে দিন এবং বাকি অংশ পড়ার জন্য পেইড সাবক্রিপশন বাধ্যতামূলক করুন। কিন্তু আপনি যদি আপনার ব্লগে পেইড সাবক্রিপশনের অপশন না রাখতে চান, তাহলেও আপনার ব্লগ পাঠকদের জন্য ফ্রি সাবক্রিপশন নেওয়া বাধ্যতামূলক করুন। এই ফ্রি সাবক্রিপশনের মাধ্যমে ব্লগ পাঠকদের তথ্য সংগ্রহ করে রাখুন। এই তথ্যগুলি আপনাকে আপনার ব্লগের মার্কেটিং এবং প্রোমশনের কাজে সাহায্য করবে।
পৃথিবীতে কোন ওয়েবসাইটের ডাইরেক্ট ট্রাফিক সবচেয়ে বেশী? এর উত্তর হলো www.google.com কারণ গুগোল সার্চ পেজ খুলতে আজও পৃথিবীর অধিকাংশ ওয়েবসাইট ব্যাবহারকারী (সেই সঙ্গে আমিও) ওয়েব ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে গিয়ে টাইপ করে www.google.com এবং তারপরে কিবোর্ডের এন্টার বোতাম টিপে গুগোলে প্রবেশ করে। এটা তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এভাবে কোনো ওয়েবসাইট ব্যাবহারকারী সরাসরি ব্রাউজারে URL থেকে ওয়েবসাইটে ঢুকলে ডাইরেক্ট ট্রাফিকের তাকে ডাইরেক্ট ট্রাফিক বলে। Google ছাড়াও YouTube, Gmail, facebook, twitter, Amazon, Flipkart, Walmart, Alibaba, Naukri এই ওয়েবসাইট গুলি প্রতিদিন লাখ লাখ ডাইরেক্ট ট্রাফিক পেয়ে থাকে। এবার গুগোল Analytics -গিয়ে চেক করুন যে আপনার ওয়েবসাইট কয়টা ডাইরেক্ট ট্রাফিক পাচ্ছে। আপনার ব্লগ বা ওয়েবসাইটের জন্য এমন ডোমেইন নেম ব্যাবহার করুন যা মানুষের অবচেতন মনে জায়গা করে নিতে পারে। এজন্য ওয়েবসাইটের নাম এবং ডোমেইন নেম বেছে নেওয়ার আগে যথেষ্ট সময় নিয়ে রিসার্চ করুন।
আপনার ওয়েবসাইটের কন্টেট, ব্যান্ড ভ্যালু, ডোমেইন নেম, ব্যান্ডউইথ, স্পিড, SSL সিকিওরিটি ইত্যদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যে ওয়েবসাইটে কি পরিমাণে ভ্যালিড ডাইরেক্ট ট্রাফিক আসবে। আগেই বলেছি ওয়েবসাইটের নাম এবং ডোমেইন নেম বাছার আগে একটি দীর্ঘ রিসার্চ অর্থৎ চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।মনে রাখবেন গুগোল, ফেসবুক এই নামগুলো একদিনে তৈরী হয়নি। এর পিছনে অনেকদিনের গবেষণা আছে। ডোমেইন কেনার সময় ডট কম ডোমেইন কেনার দিকে প্রাধান্য দিন। কারণ .com শব্দটা মানুষের বেশি মনে থাকে। কোনো কারণে .com ডোমেইন না পাওয়া গেলে কান্ট্রি ডোমেইন ব্যাবহার করুন। আপনার ব্লগ যদি ইংরেজীর পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষায় লেখা হয় তাহলে সেই ব্লগের জন্যে কান্ট্রি ডোমেইন নিন। টপ লেভেল কন্ট্রি ডোমেইন আপনাকে সঠিক ব্লগ পাঠকের কাছে পৌছাতে সাহায্য করবে।
ওয়েব ব্লগারদের বুঝতে হবে যে তাদের লড়াইটা AI এর সঙ্গে নয়। বরং AI সঙ্গে নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজের পুরোনো ধ্যান ধারণার লড়াই। আমাদের ব্লগারদের মস্তিকে যে অর্গানিক ট্রাফিকের মরচে পড়ে গেছে ওটাকে ঘষে মেজে পরিস্কার করতে হবে। আমাদের আরো নতুন পদ্ধতি শিখতে হবে। নতুন ক্রিয়েটভ আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে ব্লগ পাঠকদের কাছে পৌছাতে হবে। ব্লগ পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হবে। শেষ করছি বিখ্যাত গায়ক শ্রদ্ধেয় মান্না দে মহাশয়ের গাওয়া গানের বিশেষ লাইন দিয়ে
"যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে
পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে
হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে.. "