নতুন প্রজন্মদের কাছে টেনে নিন, ওদের পথ দেখান - Jana Dorkari Bangla

Breaking

শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪

নতুন প্রজন্মদের কাছে টেনে নিন, ওদের পথ দেখান

নতুন প্রজন্মদের কাছে টেনে নিন, ওদের পথ দেখান 

সম্পাদকীয়, November 9th, 2024

Gen Z problem and solution

আজ আমি তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সীদের উদ্দেশ্যে কিছু বাস্তব কথা বলবো। আমরা কি নতুনপ্রজন্মদের নিয়ে একটা ভিক্টিম কার্ড খেলা শুরু করে দিয়েছি? উঠতে বসতে সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্যত্র নতুন প্রজন্মদের দোষারোপ করে আমরা আসলে কি প্রমাণ করতে চাইছি যে আমরাই পারফেট। কারণ আমরা এই পরিণত বয়সে এসে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের কর্মস্থলে পারফেক্ট সিনিয়র হয়ে উঠেছি। এবং আমরা আশা করছি যে আমাদের নতুন প্রজন্মরাও পারফেক্ট হয়ে যাবে। 

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, এখনকার নতুন প্রজন্মরা আর মিস্টার বা মিস বা মিসেস পারফেক্ট হতে চাইছে না। তারা চাইছে একটু অন্যরকমভাবে নিজের দুনিয়া গড়ে তুলতে। যেখানে তাদের নিজস্ব স্পেস থাকবে। পারফেক্টসনিস্ট হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা থাকবে না। তাদের নিজেদের ইচ্ছায় বেঁচে থাকার স্বাধীনতা থাকবে। 

এখানেই আমাদের তিরিশ-চল্লিশ বছর বয়সী পারফেক্টসনিস্টদের বড় সমস্যা। আমরা ছোট বেলা থেকেই সবকিছু পারফেক্ট করার প্রতিযোগিতা অংশ নিয়ে ফেলেছিলাম। সেই প্রতিযোগিতা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডী পেরিয়ে এসে এখন কর্মজীবনে সমানতালে চলছে। প্রতিযোগিতাই মানুষ সহ সমস্ত জীবের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। বেঁচে থাকতে গেলে তাকে কোনো না কোনো প্রতিযোগিতার সন্মুখীন হতেই হবে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে সবসময় সবার প্রতিযোগিতা এবং প্রতিযোগিতায় লড়াই করার ধরণ এক রকমের হবে না।

কিন্তু আমাদের অবচেতন মন আমাদের একটাই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে যে নতুন প্রজন্মদের প্রতিযোগিতার ধরণ কেন হুবাহু আমাদের মত হবে না। অধিকাংশ মানুষ যখন পরিণত বয়সে চলে যায় তখন তারা চায় যে তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি এবং সমাজে নতুন প্রজন্মদের আচরণ, চিন্তাভাবনা এবং সংস্কৃতি যেন তাদের মতই হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না। এর মূল কারণ হলো সময়ের প্রভাব। 

বাস্তবে একবার চিন্তা করে দেখুন যে আপনারা কি হুবাহু আপনার বাবা, মা বা আপনার পূর্ববর্তী প্রজন্মের যারা যারা ছিলেন এবং আছেন তাদের মত হতে পেরেছেন? নিশ্চয়ই না। হয় আপনি তাদের থেকে অনেক ভালো কিছু করতে পেরেছেন অথবা পারেন নি। প্রতিটি মানব প্রজন্মের কিছু ইউনিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তাভাবনা থাকবেই। আধুনিক যুগে নতুন প্রজন্ম সবসময়ই পুরোনো প্রজন্মদের তুলনায় আলাদা এবং বেশি আধুনিক হবে। প্রতিদিন যদি প্রযুক্তির আপডেট এবং আপগ্রেড হয় তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে কেন হবে না?

আমাদের তিরিশ-চল্লিশ বয়সের প্রজন্ম আজ দায়িত্ববান সমাজের অংশ হয়েছে। আমরা অনুভব করতে শিখেছি যে দায়িত্ববান না হলে পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি এই পৃথিবীর কল্যাণ হবে না। ফলে আমাদের মনে এক অজানা আশঙ্কা তৈরী হয়। এই আশঙ্কা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মদেরও হত এবং এখনো হয়। আমাদের অবচেতন মনে এই আশঙ্কাও তৈরী হয় যে আমরা যখন ষাট বছরের কাছাকাছি পৌছাবো তখন এই নতুন প্রজন্মরা সবকিছু ঠিকভাবে দেখভাল করতে পারবে তো।

জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হওয়ার মূল কারণগুলো যা আমি উপরে আলোচনা করলাম। জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা তখনই তৈরী হয় যখন নতুন এবং পুরোনো প্রজন্মদের মধ্যে দোষারোপ এবং ভুল বোঝাবুঝির কারণে মাত্রারিক্ত দূরত্ব বাড়তে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এর খারাপ ফলাফল বোঝা যায় না। কিন্তু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এটা চলতে থাকলে এর সূদূরপ্রাসারী খারাপ ফলাফল হতে বাধ্য। 

নতুন প্রজন্মদের দোষারোপ করার আগে আমাদের চিন্তা করা উচিত যে তাদের যে অভ্যাসগুলো আমাদের অপছন্দ সেগুলো তাদের শিখিয়েছে বা শিখাচ্ছে কে বা কারা? যদি একটু গভীরে তলিয়ে দেখেন তখন দেখবেন আমাদের পুরোনো প্রজন্মদের দিকেই আঙ্গুল উঠতে বাধ্য। বিখ্যাত মনীষীরা বলে গেছেন যে শিশুদের মন হলো নরম মাটির মত, তাতে যে আকার দেবে সে ভবিষ্যতে তাই হবে। এই মনের আকার গড়ে ওঠা নির্ভর করে শিশুটির সঙ্গে তার বাবা মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের আচরণ, কোন আর্থিক এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে সে বড় হচ্ছে। আমরা কি সচেতন হয়ে ভেবে দেখছি যে আমাদের নতুন প্রজন্মদের মনের আকার গড়ে তোলার পেছনে কে বা কারা মুখ্যভূমিকা পালন করেছে বা করছে? তারা কি সঠিকভাবে এবং দায়িত্ব সহকারে নতুন প্রজন্মদের গড়ে তুলেছে বা গড়ে তুলছে?

নতুন প্রজন্মরা আমাদের মত হচ্ছে না বলে তাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক সমালোচনা করে আমরা কি তাদের মনে থাকা পুরোনো প্রজন্মদের প্রতি ভরসা বা আস্থাকে টলিয়ে দিচ্ছি না? পুরোনো এবং নতুন প্রজন্মদের মধ্যে বিশ্বাসবোধ যদি হারিয়ে যায় তাহলে এই পৃথিবীতে মানুষ সামাজিক বিধিনিষেধের সমস্ত বেড়াজালকে ভেঙ্গে দেবে। সেটা কি মানবজাতির পক্ষে ভালো হবে? আমরা তো ইতিমধ্যেই আমাদের মানবিকতাগুলো ধীরে ধীরে বিসর্জন দিয়েই ফেলেছি। আমরা যদি এখনো সচেতন না হই তা হলে আগামী দিনে হয়ত পরিবার বা পরিবারিক শব্দগুলো ইতিহাসের পাতায় অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন বাবা, মা, সন্তান সবাই একাকী বসবাস করবে। মানুষের প্রতি মানুষের নুন্যতম মানবিকতাবোধ বা দায়িত্ববোধ থাকবে না।

অনেক ডাক্তারবাবুদের মুখে শুনেছি তারা বয়স্ক রোগীদের বলে থাকেন যে বয়স বাড়ছে, সমস্যাগুলো একটু মানিয়ে নিতে হবে। আমাদের আজকের তিরিশ-চল্লিশ বয়সীদের এই প্রজন্ম যখন একসময় নতুন প্রজন্ম ছিলাম  আমাদের মধ্যে অধিকাংশ "মানিয়ে নেওয়া" জিনিসটি কম শিখেছিলাম। এর কারণ হলো বিশ্বায়ন এবং ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির কারণে যৌথ পরিবারে ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারে পরিণত হওয়া। আমাদের তিরিশ-চল্লিশ দের অধিকাংশই ক্ষুদ্র অর্থাৎ অ্যাটমিক পরিবারে বড় হয়েছি। ফলে শেয়ারিং এবং কেয়ারিং এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের খুবই সীমাবদ্ধ ছিলো।

এখন ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল ডিভাইসের সুবাদে নতুন প্রজন্ম খুব সহজেই নতুন জিনিস শিখতে পারে। যদিও আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি যার শেখার খিদে বা আগ্রহ আছে সে যেকোনো বয়সেই শিখতে পারে। এই শেখার ধরনগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে। আমাদের সেটার সঙ্গে নিজেকে আপডেট বা মানিয়ে নিতে হবে। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বজরা শিলালিপি, গাছের ছালে লেখা লিপি দেখে শিক্ষালাভ করতেন। তাঁরা যে পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করতেন আমরা নিশ্চয়ই সেই পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করিনি। সুতরাং নতুন প্রজন্মও যে আমাদের মত একই পদ্ধতিতে বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকে নোটের পর নোট লিখে মুখস্ত করে শিক্ষাগ্রহণ করবে এটা আশা করা সঠিক নয়। বরং তারা যেভাবে শিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেভাবে তাদের শেখার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

অনেকেই মনে করেন যে ছোটদের হাত থেকে মোবাইল সহ অনান্য স্মার্ট ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের সুবিধা দূরে রাখলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু আমার আপনার সন্তান যদি স্কুল কলেজে পড়ে। ফলে একটি সামাজিক পরিসরে সে নিয়মিত মেলামেশা করে। অন্যদের দেখে প্রাভাবিত হয় এবং শিখতে চায়। তখন অনিবার্যভাবে তার কাছে স্মার্ট ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের চাহিদার সৃষ্টি হয়। চাহিদা মানুষের মনে আবেগ সৃষ্টি করে। এই আবেগ অনেকটা দুরন্ত নদীস্রোতের মত। নদীতে বাধ দিয়ে কি তার চলার গতিকে পুরোপুরি আটকানো যায়? মাঝে মাঝে বাধ দিয়ে জল ছেড়ে দিতে হয়। না হলে নদী নতুন করে তার চলার রাস্তা ঠিক খুঁজে নেয়। আমরাও আমাদের সন্তানদের চাহিদার আবেগকে পুরোপুরি আটকে রাখতে পারি না। যদি আটকে রাখতে যাই তখন সে চাহিদা পূরণ করার জন্য অনেক সময় ভুলপথে যেতে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

কিছু প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরও সবসময় করা উচিত, বিশেষত আমরা তিরিশ-চল্লিশ বছর বয়সীরা নিজেরাই কি স্মার্টফোন বা অন্য স্মার্ট ডিভাইস ব্যাবহার, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাস্ততা, অনলাইনে ভিডিও দেখা এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি বা  কি মনে হয় ভবিষ্যতে পারবো? ভবিষ্যতে অবসরজীবনে বা বৃদ্ধ বয়সে আমাদের সময় বা অসময়ের সঙ্গী কি আমাদের স্মার্ট ডিভাইস হবে না আমাদের নতুন প্রজন্ম হবে? কোনটার আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারবো সেটা আমাদের এই বয়স থেকেই ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে। অবশ্য আমাদের এখন ভাবনা চিন্তা করার সময় কোথায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই আমাদের হয়ে ভাবনাচিন্তা করে ভবিষ্যতবাণী করছে। 

তাহলে সমস্যার সমাধান কোথায়? নতুন পুরোনো প্রজন্মদের মধ্যে ব্যাবধান কিভাবে ঘুচবে? আমরা কি সময়ের ওপরে সবকিছু ছেড়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি এই ভেবে যে সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সময়ের কাজ হলো সবকিছুর পরিবর্তন ঘটানো। সবকিছু ঠিক করা সময়ের কাজ সবসময় নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাবধান ঘুচানোর জন্য আমদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমে আমাদের অর্থাৎ আমাদের পুরনো প্রজন্মদের এই আশা ত্যাগ করতে হবে যে নতুন প্রজন্মরাও আমাদের মত পারফেক্ট করবে। নতুন প্রজন্মরা ভুল করবে, ভুল সিদ্ধান্ত নেবে সেখান থেকে ঠকে শিখবে এটাই বাস্তব এবং তা মেনে নিতে হবে। নতুন প্রজন্মদের মধ্যে যাদের বয়স পনেরো থেকে উনত্রিশ বছর পর্যন্ত তাদের আমাদের মত পুরোনো পদ্ধতিতে নীতিবোধের পাঠ দিতে গেলে তারা শিখবেই না উলটে তারা ভুল পথে চলবে। বরং ওরা যেভাবে চলতে চাইছে সেভাবে চলতে দিন। আমাদেরই ধৈর্য্য ধরে নতুন প্রজন্মদের বুঝতে হবে, ওদের গার্জিয়ান অথবা বস হওয়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে ওদের মেন্টর এবং বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। নতুন প্রজন্মদের মানসিক চাহিদাগুলো বুঝতে হবে, সেগুলো কিভাবে সঠিক উপায়ে পূরণ করা যায় যাতে জেনারেশন গ্যাপের সমস্যাগুলো কমানো যায় সেগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করে পথ বের করতে হবে।

আমরা অনেকেই এখন আমাদের ব্যাস্ততার অহেতুক দোহাই দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাস্ত করে রেখেছি। লাইক, কমেন্ট, স্ক্রীনে স্ক্রলিং করতে করতে অথবা ভিডিও স্ট্রিমিং দেখতে দেখতে আমরা ভীষন ব্যাস্ত এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। কিন্তু এদিকে নতুন প্রজন্ম আমাদের দৃষ্টি আকষর্ণ করার চেষ্টা করেছে, তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে, তারা আমাদের কাছে সময় চেয়েছে। আমরা তখন বিরক্ত হয়ে তাদের হাতে ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত স্মার্ট ডিভাইস ধরে দিয়েছি। স্মার্ট ডিভাইস ব্যাবহার করা তাদের অভ্যাসে করিয়েছি। কিন্তু কিভাবে তারা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করছে সেটা আমরা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি যতদিন না নিজেদের সংসারে বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এখন আমরা বিভিন্ন অ্যাপ নিষিদ্ধ করে কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার দাবি করতে পারি? না আগে নিজেদের দোষগুলির শোধরানোর চেষ্টা করতে পারি। আমাদের সন্তানদের বয়স যদি ছয় থেকে পনেরো বছরের মধ্যে হয় তাহলে তাদের বয়স অনুসারে কম পরিশ্রম যুক্ত সহজ সরল কাজ থেকে ধীরে ধীরে জটিল গৃহস্থালী কাজ শেখানো উচিত, বিভিন্ন পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করানো উচিত।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ডিজিটাল ডিভাইস এবং ডিজিটাল লাইফ আমাদের ধৈর্য্য শক্তি কমিয়ে দিয়েছে। এখন এর সঙ্গে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রলিং এবং শর্ট টাইমের ভিডিওগুলি দেখার অভ্যাস আমাদের মনযোগ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমিয়ে দিয়েছে। এতে নতুন এবং পুরোনো উভয় প্রজন্মই অনেকের মনযোগ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বর্তমান সময়ে অনেকের পক্ষেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহার থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া এবং শর্ট টাইমের ভিডিওগুলি দেখার সময় প্রতিদিন ধীরে ধীরে কমাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার অভ্যাস একদিনে ত্যাগ করে বেরিয়ে আসা সময় নয় এজন্য আমাদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে। নতুন প্রজন্মদের ক্ষেত্রে তারা যতদিন না সাবালক বয়সী না হচ্ছে ততদিন তাদের সোশ্যাল মিডিয়া এবং শর্ট টাইমের ভিডিওগুলি থেকে দূরে রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মদের ধীরে ধীরে লং টাইমের ভিডিও দেখার অভ্যাস করাতে হবে। পুরোনো প্রজন্মদের বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে গেলে ফিরিয়ে আনতে হবে।

সবথেকে বেশি সমস্যার কথা শুনি স্কুলগুলিতে বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের একই অভিযোগ যে নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা তাদের কথা শুনতেই চাইছে না। তারা পড়াশোনায় মন দিতে চাইছে না। তারা কোনো কোনো সময় ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। এটা ভুললে চলবে না যে এই স্কুলগুলো থেকেই ভবিষ্যতে পৃথিবীর জন্য মানুষ তৈরী হয়। স্কুলে যদি শিক্ষক ছাত্র উভয়েই যদি স্ট্রেসের মধ্যে থাকে তাহলে সার্বিক বিকাশের পক্ষে বাধা হতে পারে। আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা ব্যাস্ত ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাস, আসাইমেন্ট এবং আসেসমেন্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে। সবাই স্মার্ট টিচার হতে বাধ্য। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী স্মার্ট সিলেবাস, স্মার্ট টিচিং পদ্ধতি নিয়ে পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব আছে। এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রতিবছর শিক্ষাপদ্ধতিতে বদল এবং নতুনত্ব আসেনা কেন? শিক্ষাব্যাবস্থায় উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব থাকার জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের ক্লাস বোরিং মনে হয়, তারা ক্লাসে ক্লান্ত এবং উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এই পৃথিবীতে স্মার্ট ডিভাইস গুলোকে কিভাবে আরো স্মার্ট করে তোলা যায় সেগুলি নিয়ে চূড়ান্ত গবেষণা চলছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের পড়ার বিষয়গুলিকে কিভাবে আরো বেশী করে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় সেজন্য নিয়মিত কি কোনো গবেষণা হচ্ছে? বা এই সংক্রান্ত কোনো  খবর শোনা গেছে বা যাচ্ছে? 

নতুন প্রজন্মের স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের যদি মনসংযোগ করার ক্ষমতা কমে গেছে। তাহলে কিভাবে ধীরে ধীরে পরিকল্পনামাফিক তাদের মনসংযোগ বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আমাদের টিচারদের পরিকল্পনা নিতে হবে। বই পড়ে বা মোবাইল কম ব্যবহার করে তাদের ধৈর্য্য বাড়ানোর উপদেশ দিলে সেটা কখনই বাস্তব রূপ পাবে না। নীচু ক্লাসে পড়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের বয়স কম থাকার ফলে তাদের ধৈর্য্যশক্তি কম হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিটি ক্লাস পিরিয়ডের সময় কমাতে হবে। তাদের সিলেবাসের বোঝা কমাতে হবে। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীরা যত তাদের উঁচু ক্লাসে উঠবে, তাদের ক্লাস পিরিয়ডের সময় বাড়বে। তখন তাদের সিলেবাসের পরিধি বাড়বে। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সময় টেক্সের তুলনায় ভিজুয়ালাইজেশনের দিকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে ডিজিটাল বোর্ডের ব্যাবস্থা করতে হবে। যাতে আমাদের শিক্ষকশিক্ষিকারা ছবি এবং এনিমেশনের মাধ্যমে শিক্ষাদানকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের কল্পনা, উদ্ভবনীশক্তি এবং তাদের দক্ষতাগুলোকে উৎসাহ দিতে হবে। তবে আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদের অনেকেই আছেন যারা নতুন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভালো কিছু করতে চাইলেও নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের আমরা যারা অভিভাবক  বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াই। কারণ সেই পারফেক্ট করার প্রবণতা। একই চিন্তা আমাদের অভিভাবকদের মনে ঘোরাফেরা করে যে আমার ছেলে মেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। ছেলে মেয়েরা হাইস্কুলে (ভারতের ক্ষেত্রে হায়ার সেকেন্ডারি) এবং কলেজে ঢুকলেই আবার আমাদের অভিভাবকদের মনে আবার পারফেকশোনের চিন্তায় টার্নিং আসে। তখন সেখানে আরো নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হয় যেমন হার্ভাড, এমআইটি, আইআইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ, সিএ, এমবিএ, আইএএস ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলস্বরূপ আমরা পারফেক্ট পুরোনো প্রজন্মরা এখন নতুন প্রজন্মদের মনে অবশ্যই ভয় এবং সংশয় ঢুকিয়ে দিয়েছি, দিচ্ছি এবং ভবিষ্যতে দেবো। ফলে নতুন প্রজন্মরা কাজের যোগ্যতা অর্জন করুক বা না করুক তারা কিন্তু ঠিক চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছে। এই যেমন ভর্তি হতে পারব তো, লোন পাবো তো, স্কলারশিপ পাবো কিভাবে, কলেজ শেষে প্লসেমেন্ট হবে তো, যা প্যাকেজ দেবে তাই দিয়ে লোন শোধ করতে পারবো তো। এই ভাবনার আর শেষ কোথায়!

এই চিন্তাভাবনার মহা জালে জড়িয়ে পড়তে পড়তে আমাদের ত্রিশ-চল্লিশের অধিকাংশেরই মাথার চুল, গালের দাড়ি পাকতে শুরু করে দিয়েছে। পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্র সর্বত্র পারফেক্ট হতে চাই, কিন্তু নিজের জন্য পারফেক্ট অনেক দূরের কথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার জন্য নুন্যতম যে খেয়াল নিজেদের প্রতি রাখা দরকার সেটাই করে উঠতী পারি না। জিমে গিয়ে ঘাম ঝরিয়ে বেশ পেশিবহুল আকর্ষণীয় চেহারা বানিয়ে নিচ্ছি কিন্তু শরীরের ভেতরের যন্ত্রাংশ সঠিক পুষ্টির অভাবে তিরিশ বয়স পেরলেই তার প্রভাব পড়তে শুরু করে যেমন ক্লান্তি, কোমরে ব্যাথা ইত্যাদি। শরীরে ক্রনিক রোগ শুরু হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। তিরিশ বছর পেরলেই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মদেরও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। কারণ তাদের অধিকাংশই পরিবেশের দূষিত বায়ু, কম পুষ্টিযুক্ত খাবার, বিষাক্ত রাসায়ানিক যুক্ত খাবার গ্রহণ করে বড় হচ্ছে। ফলে তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছালেই তাদের অধিকাংশের শরীরে অকাল বার্ধক্য চলে আসবে। উদাহরণ স্বরূপ বর্তমান সময়ে যেমন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ পেরলেই যেন শরীরে বার্ধক্য চলে আসছে। এই সমস্যাগুলি দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে সবথেকে বেশী দেখা যাচ্ছে। 

 নতুন প্রজন্মদের কাছে সবথেকে বড় সমস্যা হলো যে তারা ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল জগতে বেশ স্বচ্ছন্দ হলেও বাস্তব জগতে তারা একটু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেই তারা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ছে এবং প্রতিরক্ষামূলক আচরণ করছে। ফলে তাদের স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি এবং নতুন চাকরী জীবনে প্রভাব পড়েছে। ছাত্রজীবন বা কর্মজীবনে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসর জন্য তারা বাস্তব জগতের পরিবর্তে ডিজিটাল জগতের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এখানেই হয়ে যাচ্ছে বিরাট সমস্যা। অধিকাংশ সময়েই প্রত্যেকের হতাশার কারণ একরকম হয় না। হতাশার সঠিক কারণ নির্নয় করে সঠিক উপায়ে হতাশা দূর করতে ব্যাবস্থা করা দরকার। কিন্ত নতুন প্রজন্মরা হতাশা দূর করার জন্য  ডিজিটাল জগতে ঢুকে অসংখ্য মোটিভেশনাল ভিডিও দেখে যাচ্ছে। অনেকটা রোগের কারণ এবং দূর করার উপায় না জেনেই বিভিন্ন ওষুধের ককটেল খেয়ে নেওয়া। না বুঝে মোটিভেশনাল ভিডিও দেখলে মানুষ আরো হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে। এমনকি বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে। 

অনেকসময় দেখা যায় যে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অথবা ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটে ব্যাবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন মোটিভেশনাল ভিডিও দেখে নতুন এবং পুরোনো উভয় প্রজন্মদের মধ্যে অনেকে তাদের সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে তাদের চাকরি ছেড়ে দেয়। তারপরে তাদের মধ্যে কিছু অংশ ব্যাবসা শুরু করার আগেই মূলধন এবং পরিকল্পনার অভাবে হতাশায় ডুবে যায় এবং নিজেদের ভুল বুঝে আবার চাকরিতে ফিরে যায়, বাকিরা ব্যাবসা শুরু করে। যারা ব্যাবসা শুরু করে তাদের মধ্যে যারা ধৈর্য্য, সঠিক পরিকল্পনা এবং সাহস নিয়ে ব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারে তারাই লং টার্মে ব্যাবসা করতে পারে। বাকীদের ব্যাবসা কয়েক মাস অথবা কয়েক বছরের মধ্যেই গুটিয়ে যায়। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ব্যাবসায় অতিরিক্ত দেনা হয়ে যাওয়ার জন্য চরম হতাশায় ডুবে যায়। ব্যাবসা শুরুর আগে একটা জিনিস সবসময় মনে রাখা উচিতে যে ব্যাবসায় প্রফিট করা এবং লটারিতে পুরুষ্কার জেতা এক জিনিস নয়।

নতুন প্রজন্মদের পুরোনো প্রজন্মদের কাছে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। আবার পুরোনো প্রজন্মদেরও মনের সংকোচ দূর করে নতুন প্রজন্মদের কাছ থেকে নতুন টেকনোলোজি সম্পর্কে শিখতে হবে জানতে হবে। মনের সংকীর্ণতা দূর করে নতুন প্রজন্ম এবং পুরোনো প্রজন্ম পরস্পরের মধ্যে নিয়মিত তথ্যের আদান প্রদান করলে দুই প্রজন্মের মধ্যে ব্যবধান অনেকটা কম হবে। এক্ষেত্রে আমাদের তিরিশ-চল্লিশ বয়সীদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মদের সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। নতুন প্রজন্মদের মধ্যে যে নবীন শক্তি আছে সেটাকে সঠিক কাজে লাগাতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে ইতিহাস আমাদের তিরিশ-চল্লিশ বয়সীদের দিকে অঙ্গুল তুলে বলবে যে "কেন তোমরা নতুন প্রজন্মদের পথ দেখাও নি?"



লেখকঃ কৌশিক সরকার
[জানা দরকারি ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা]